নিজস্ব প্রতিবেদক | রবিবার, ০৪ এপ্রিল ২০২১ | প্রিন্ট
দালালের দৌরাত্ম্য, জনবল ও শয্যা সংকটসহ নানা সমস্যায় চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। দীর্ঘদিন ধরে এই অবস্থা চলে আসলেও সমাধানের উদ্যোগ নেই স্বাস্থ্য বিভাগের। এতে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা বিভিন্ন বয়সী মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলা সদর থেকে মনোহরদী উপজেলা হাসপাতালের দূরত্ব ৩২ কিলোমিটার। ১৯৩.৬০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই উপজেলায় ২ লাখ ৮৪ হাজার ৬৬৩ জন মানুষের বসবাস। এছাড়াও পার্শ্ববর্তী গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া, নরসিংদীর বেলাব, কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়াসহ বেশ কিছু এলাকার রোগীরা চিকিৎসা সেবা নিতে আসেন এই হাসপাতালে।
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, ৫০ শয্যা বিশিষ্ট এই হাসপাতালে ৫০ শয্যা থাকার কথা থাকলেও রয়েছে ১৯টি। বারান্দা ও সিড়ির নীচে পরিত্যক্ত অবস্থায় রাখা হয়েছে বাকি শয্যাগুলো। এরমধ্যে কয়েকটিতে রোগীও আছেন। হাসপাতালটিতে ৩১ জন চিকিৎসকের বিপরীতে ১৮ জন চিকিৎসকের পদ শূন্য রয়েছে। কর্মরত ১৩ জন চিকিৎসকের মধ্যে মেডিকেল অফিসার রয়েছেন ৬ জন। এই ৬ জনের মধ্যে দুইজন আছেন ছুটিতে। মাত্র ৪ জন মেডিকেল অফিসারের ওপর ভর করে চলছে চিকিৎসা সেবা।
সরকারি এই হাসপাতালের পাশেই গড়ে উঠেছে ৭ টি বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতাল। এসব বেসরকারি হাসপাতালের চিহ্নিত দালালের সংখ্যা ২০ জনেরও বেশি। দালালরা কাজ করে কমিশনের বিনিময়ে, রোগী প্রাইভেট হাসপাতালে নিতে পারলেই নগদ টাকা পাচ্ছে দালাল চক্র। শয্যা ও চিকিৎসক সংকটসহ দালালের দৌরাত্ম্য, প্রাইভেট হাসপাতালের প্রতি ডাক্তারদের ঝুঁকে যাওয়ার কারণে চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা।
মনোহরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর গেইট দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ে এসব দালালদের দৌরাত্ম্য। এসব দালালরা ফুসলিয়ে রোগী নিয়ে যেতে তৎপর। হাসপাতালে চিকিৎসকের কক্ষের সামনে লেগে থাকছে রোগীর ভীড়। কেউ দাড়িয়ে আছেন দেড় ঘন্টা ধরে, কেউ আবার ২ ঘন্টা। সকলের মুখেই বিরক্তির ছাপ। মাত্র ৪ জন মেডিকেল অফিসারের ওপর ভর করে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা।
মনোহরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর অফিস সহায়ক আবুল কালাম বলেন, প্রতিদিন ২০-২৫ জন দালাল হাসপাতালের আশেপাশে ঘুরাঘুরি করে। রোগীর চাপ থাকলে দালালের সংখ্যাও বেশি থাকে। তাদের উদ্দেশ্য এখান থেকে রোগী ফুসলিয়ে প্রাইভেট হাসপাতালে ঢুকানো। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই নারী। আশেপাশে যারা ফার্মেসি পরিচালনা করেন তারাও এলাকার রোগী নিয়ে আসেন কমিশনের বিনিময়ে। প্রাইভেট হাসপাতালে রোগী দিতে পারলেই মেলে কমিশনের টাকা।
দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাড়িয়ে থাকা ইয়াসমিন বেগম বলেন, তার ৬ মাসের শিশুকে নিয়ে এসেছেন ডাক্তার দেখাতে। কি ডাক্তার দেখাবেন, কাকে দেখাবেন কিছুই জানেন না তিনি। সবাই লাইনে দাড়িয়েছেন দেখে তিনিও লাইনে দাড়িয়ে আছেন। অসুস্থ শিশুকে কোলে নিয়ে দাড়িয়ে নিজেও অসুস্থতা বোধ করছেন। চিকিৎসক সংকটের কারণেই এমন দশা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
চিকিসাৎ সেবা নিতে আসা কলেজ শিক্ষক সালাউদ্দিন মোড়ল বলেন, এমন বেহাল দশায় হাসপাতাল চলতে পারে না। ডাক্তার নাই পর্যাপ্ত, রোগীর লাইন লেগে থাকে, রোগী শেষ হয় না। অনেকগুলো বেড বাইরে পড়ে আছে। দালালদের বাড়াবাড়িতো আছেই। তারা রোগীদের প্রাইভট হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে কমিশনের বিনিময়ে। অতিষ্ঠ হয়ে অনেক রোগী নিজেই প্রাইভেট ক্লিনিকের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হচ্ছেন।
মিনারা বেগম নামে আরও একজন বলেন, গত সপ্তাহে এসে ডাক্তার দেখাতে পারিনি। লাইনের রোগী শেষ না করেই ডাক্তার চলে গেছেন। আজকে আসছি, আজকেও লম্বা সিরিয়াল। পায়ের ব্যাথায় দাড়াতে পারি না। এভাবে কতক্ষন থাকা যায়? এমন সমস্যার সমাধান চাই আমরা।
যোগাযোগ করা হলে মনোহরদী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: শামীম বলেন, একা আমার পক্ষে দালালের দৌরাত্ম্য দূর করা সম্ভব নয়। তাছাড়া এখানে ভবন নেই। নির্মাণাধীন ভবন রয়েছে একটি, এটার কাজও ধীরগতিতে হচ্ছে। আয়া আছে দুইজন, ডাক্তার থাকার কথা ৩১ জন। আছে মাত্র ১৩ জন। এর মধ্যে আবার দুইজন ছুটিতে। শূন্য পদই রয়েছে ১৮ টি। এই অল্প সংখ্যক ডাক্তার প্রতিদিন গড়ে দেড় হাজারের বেশি মানুষকে সেবা দিচ্ছেন। নতুন ডাক্তার যোগদান করলেও বসার জায়গা নেই। নতুন ভবন নির্মাণ না হলে সমস্যা পুরোপুরি কাটানো যাবে না। নতুন ভবনের কাজ এতদিনে ১০ শতাংশও শেষ হয়নি।
ভবন তৈরির কাজের দ্বায়িত্বে থাকা নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ঢাকা মার্কেন্টাইল কর্পোরেশনের ম্যানেজার শরিফুল ইসলাম বলেন, আগস্টে কাজ পুরোদমে শুরু করার কথা থাকলেও বিভিন্ন জটিলতার কারণে কাজ শুরু করতে হয়েছে নভেম্বরের শেষের দিকে। করোনার কারণে চারতলা এই ভবনের কাজে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। তবে এক বছরের মধ্যে কাজ শেষ হবে বলে আশা করছি।
নরসিংদীর সিভিল সার্জন ডা. মো: নুরুল ইসলাম বলেন, পুরাতন একটি ভবন ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। যার ফলে ৫০ শয্যার হাসপাতাল হলেও সবগুলো শয্যা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। নতুন ভবনের কাজ শেষ করে ওঠতে বছর দেড়েক সময় লাগবে। আশাকরি তখন ৫০ শয্যার হাসপাতালে ৫০ শয্যাই কাজে লাগাতে পারবো। এছাড়া ডাক্তার সংকটের বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে। দালালের দৌরাত্ম্য দু:খজনক উল্লেখ করেন তিনি জানান, দালালের দৌরাত্ম্য প্রতিরোধে আমরা আগে থেকেই সোচ্চার ছিলাম, এখনও আছি। তবুও তাদের দালালের দৌরাত্ম্য রয়ে গেছে। আমরা পুলিশি অভিযান চালাবো, আশা করি কিছুদিন পর এটাও থাকবে না।
Posted ১:২৩ অপরাহ্ণ | রবিবার, ০৪ এপ্রিল ২০২১
Desh24.news | Azad
.
.