শনিবার ১৪ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৩০শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

করোনা আর দারিদ্রতার কষাঘাতে থমকে গেছে নরসুন্দর নিতাইয়ের সংসার

মোঃ শফি আলম, ঘিওর (মানিকগঞ্জ) সংবাদদাতা   |   বুধবার, ২৮ এপ্রিল ২০২১ | প্রিন্ট  

করোনা আর দারিদ্রতার কষাঘাতে থমকে গেছে  নরসুন্দর নিতাইয়ের সংসার

হাতে ব্যাগ, বোগলে একটি টুল। ব্যাগের ভিতরে ছোট আয়না, ক্ষুর, কেচি, এক টুকরা সাবান ও একটি ব্রাশ নিয়ে রাস্তার পাশে ৩টি ইটের উপরে খোদ্দের বসিয়ে খৌড়কর্ম করেন নরসুন্দর নিতাই (৫২)। পুঁজি না থাকায় ২৩ বছর যাবৎ খোলা আকাশের নিচে চলছে তার ভ্রাম্যমান সেলুন। প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০ টাকা রোজগার করেন তিনি। বয়সের কারনে বর্তমানে তার কাছে চুল দাঁড়ি কামাইতে কোন খোদ্দের আসেনা। এর পরে করোনা ভাইরাসের কারনে তার জীবন যাত্রার মান আরো থমকে দাঁড়িয়েছে।

সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, ঘিওর উপজেলা সদরের কুস্তা কবরস্থানের পাশে প্রতিদিন সকাল ৮ থেকে ২টা পর্যন্ত কাজ করে মাঝে মধ্যে ৪০- ৫০ টাকা আবার খালি হাতে বাড়ি ফিরতে হয়। স্ত্রী ও সন্তানের মুখে দু-মুঠো খাবার তুলে দেবার জন্য প্রতিদিন সকালে খৌরকর্মের জন্য বের হয় নিতাই শীল। মানবিক কারনে ২/১ জন বয়স্ক লোকজন আসলেও ইটের উপরে বসে খোলা আকাশের নিচে কেউ দাড়িঁ, চুল কামাতে চায়না। অভাব অনটনের কারনে তার আদরের সন্তান গোপাল (১৪) কে দাদুর বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তপ্ত রোদে নরসুন্দর নিতাইয়ের শরীর বেয়ে ঘাম ঝরছিল। মাথায় কাঁচাপাকা বড় চুল। মুখে খোচাখোচা দাঁড়ি। নোংরা, ময়লা লুঙ্গি ও ছেড়া শার্ট পরে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। চোখে মুখে হতাশার ছাপ। আয় রোজগার না থাকায় অর্থকষ্টে মানবেতর জীবনযাপন করছে ঘিওর উপজেলার নিম্ন আয়ের সেলুন ব্যবসার জড়িত এ সব মানুষ।


নিতাই শীল অভিমান করে তিনি বলেন, আমাদের দিয়া কেউ কাম করাইতে চায়না। আমাগো দিকে কেউ নজর দেয়না। আমার ঘর নাই, জমি নাই। থাকার মতো কোন ব্যবস্থা নেই। স্ত্রী, ছেলে নিয়া বহু কষ্ট, কইরা বাইচা আছি। কয়েক দিন ধইরা রুটি খাইয়া কোনমত দিন কাটাই। ঘরে চাল, ডাল কিছুই নাই। বহু বছর কষ্ট কইরা চলতাছি। রোজগার প্রায় বন্ধের পথে। সরকারি-বেসরকারি কোন সাহায্য পাইনা। অসুস্থ শরীর নিয়া রোদে বইসা থাকতে হয়। কিন্তু কেউ আমাগো দিকে তাকাইনা। আমাগো দেইখা অনেকে অবহেলা করে। আপনারা আমাগো কথাটা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌছাঁইয়া দেন।

সরেজমিন তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, নরসুন্দর নিতাই শীলের বাড়ির চারপাশে নোংরা, ময়লা আবর্জনার স্তুপ। মাঝখানে ছোট ৮/১০ টিনের একটি ছাপরা ঘর। ঘরের ভিতরে নড়াচড়া করা যায় না। যাতায়াতের ব্যবস্থা নেই। বেড়াগুলো ভাংগাচোরা পলিথিন দিয়ে জড়ানো। বৃষ্টির সময়ে ছাপরা ঘরটি দিয়ে জল পরে বিছানাপত্র, কাপড়চোপরসহ সমস্ত কিছু ভিজে নষ্ট হয়ে যায়। ঝড় বন্যার সময় স্কুল, কলেজের বারিন্দায় আশ্রয় নিতে হয়। অন্যের জমিতে নোংরা ও জরাজীর্ণ ছাপড়া ঘরে স্ত্রী, ছেলে নিয়ে কোন রকম দিন কাটাতে হয় নরসুন্দর নিতাইকে। দীর্ঘ প্রায় ২৩ বছর যাবৎ কুস্তা এলাকায় খাদ্য গুদামের সামনে রাস্তার পাশে গাছ তলায় খোলা আকাশের নিচে বসে খোরকর্ম করেন তিনি। চেয়ার, টেবিল, আয়না,আধুনিক সরমঞ্জামাদি ও ঘর ভাড়া নিয়ে সেলুন দেবার মতো তার সামথ্য নেই। যা রোজগার করেন তা দিয়ে একবেলার খাবার তাদের জোটেনা। এর পরে তার ৭ম শ্রেনীতে পরুয়া একমাত্র ছেলের পড়ালেখার খরচ। দিনের অনেকটা সময় তাঁর ফুটপাতেই কাটে। তার পরে সুর্য পশ্চিমে হেলালে বাড়িমুখি হয়ে যান তিনি। তবুও কারও কাছে হাত পাতেনি নরসুন্দর নিতাই শীল।

সাংবাদিকদের কথা শুনে ছাপরা ঘর থেকে বেড়িয়ে এলেন তার স্ত্রী আলো রানী শীল। বেলা ১২টা বাজে তখনও সকালের নাস্তা তাদের ভাগ্যে জোটেনি। চাল না থাকায় আগের রাতে রুটি খেয়ে রাত কাটান তারা। আজকে দুপুরে রুটি বানাবে বলে তিনি সাংবাদিকদের জানালেন। কোরোনা ভাইরাসের মধ্যে প্রায় এক বছর যাবৎ তারা বহু দুঃখ,কষ্ট করে জীবন যাপন করছেন। তার স্বামী নিতাই শীল যে টাকা আয় করেন তা দিয়ে তাদের সংসার চলেনা। কখনও রুটি আবার কখনও এক বেলা ভাত খেতে হয়। আবার কোন দিন উপাস থাকতে হয় তাদের। দীর্ঘদিন যাবৎ দুঃখ, দারিদ্র্যের কষাঘাতে বির্পযস্ত হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করলেও কেউ এগিয়ে আসেনি। তবে দুঃখের বিষয়, অভাব, অনটনের মধ্যে একটি ভিজিএফ ও ভিজিডি কার্ড কিংবা কোন ধরনের সরকারি সহযোগিতা পায়নি। জোটেনি সরকারি ঘর কিংবা খাস জমি।

নরসুন্দর নিতাই ১৯৬৯ সালে উপজেলার পয়লা ইউনিয়নের তেরশ্রী গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। বাবা উপেন শীলের কাছ থেকে তার খোরকর্মের হাতেঘড়ি। বিভিন্ন হাট বাজারে বসে তার বাবাও চুল দাড়ি কামানোর প্রথাকে আগলে রুটি রুজির সন্ধানে বেড়িয়ে পরতেন। পৈতিক পেশার কারনে তিনি জীবনের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। নিতাই শীলের বাবা মারা যাবার পরে অল্প বয়সেই তাকে পৈতিক সুত্রে এ পেশা বেছে নিতে হয়েছে।

ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ অহিদুল ইসলাম টুটুল জানান, আমি নিতাইয়ের পরিবারের সাথে কথা বলেছি। দ্রুত তার জন্য ভিজিডি কার্ডসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

ঘিওর বাজার কমিটির সাধারন সম্পাদক ও আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক আব্দুল মতীন মুসা জানান, আমি প্রায় ২২/২৩ বছর যাবৎ নিতাই শীলকে থাকার আশ্রয় দিয়েছি। এর মত অসহায়, দরিদ্র লোক ঘিওরে নেই বললেই চলে। আমরা সবাই মিলে অসহায় পরিবারটির পাশে দাড়ালেই তার জীবন যাত্রার মান বদলে যাবে। এ ছাড়া বর্তমান সরকার অসহায়, দরিদ্র জনগোষ্ঠিদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপকভাবে সারা দেশে কাজ করে যাচ্ছেন। আশাকরি অসহায় এই পরিবারটির ভাগ্য উন্নয়নে সকল প্রকার প্রযোজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করবেন।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার আইরিন আক্তার জানান, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ কোন মানুষ গৃহহীন ও ভূমিহীন থাকবেনা। ইতোমধ্যে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ভুমিহীন ও গৃহহীনদের তালিকায় নাম ওঠার পরে যাচাই বাছাই করা হবে। আগামী বাজেট আসলে অবশ্যই ওই পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

 

 

 

Facebook Comments Box

Posted ৭:২৯ অপরাহ্ণ | বুধবার, ২৮ এপ্রিল ২০২১

Desh24.news |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

এ বিভাগের আরও খবর

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০  
এম আজাদ হোসেন সম্পাদক ও প্রকাশক
বার্তা ও সম্পাদকীয় কার্যালয়

শ্রীসদাস লেন,বাংলাবাজার , ঢাকা-১১০০/ ঘিওর, মানিকগঞ্জ।

হেল্প লাইনঃ +৮৮০১৯১১৪৭৭১৪১/০১৯১১২২৭৯০৭

E-mail: infodesh24@gmail.com